মানসম্পন্ন বীজ এবং ধানের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমাতে হারমেটিক স্টোরেজ
কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন
পৃথিবীর ইতিহাস পরিবর্তনে যে ক’জন মহান নেতা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে মনের অজান্তেই চলে আসে একটি নাম, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাজীবন জাতির জন্য সংগ্রাম এবং মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বে এক অনুকরণীয় নেতায় পরিণত হন।
বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন যে, কৃষির উন্নয়নের মধ্য দিয়েই কেবল বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসতে পারে। আর সে কারণেই সাড়ে তিন বছরের শাসন সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য গড়ে তোলেন বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালে দেশে তুলার চাষ সম্প্রসারণ করার জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। পুনর্গঠন করেন হর্টিকালচার বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ও রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু কৃষিতে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বীজ ও সার সরবরাহের প্রতিষ্ঠান বিএডিসিকে পুনর্গঠন করে সারাদেশে বীজকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩ সালে কৃষিতে গবেষণা সমন্বয়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং নতুন নামে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে উন্নীত করেন বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে। এছাড়া তিনি ঈশ্বরদীতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিষ্ঠা করেন পরামাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করে তিনিও কৃষি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছেন। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নের্তৃত্বে কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে অনন্য রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বিবেচনায় প্রতি বছর সাড়ে তিন থেকে চার কোটি টন খাদ্যের চাহিদা রয়েছে যার পুরোটাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা (এফএও) এর মিটিং দ্য আন্ডার নিউট্রিশন চ্যালেঞ্জ প্রকল্পের সিনিয়র এসডিজি স্পেশালিস্ট খাদ্য নষ্ট ও অপচয় বিষয়ে বলেন, সারাবিশ্বে প্রতি বছর উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যায়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ খাদ্য নষ্ট হয় যার আর্থিকমূল্য দাঁড়ায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার। বিক্রেতা ও ভোক্তাপর্যায়ে কী পরিমাণ খাদ্য অপচয় হচ্ছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। তিনি আরো বলেন, যখন খাদ্য নষ্ট হয় তখন আসলে খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত অন্যান্য সম্পদ যেমন পানি, ভূমি, বিদ্যুৎ, শ্রম, পুঁজি ইত্যাদিরও অপচয় হয়।
মহামারী, যুদ্ধ সেইসাথে জলবায়ুর চরম বিরূপ ইত্যাদি কারণে বিশ্বে খাদ্য সংকটের ঘণ্টা বেজে উঠছে যখন বিশ্বে খাদ্যের অপচয়ও বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে বছরে খাদ্যের অপচয় ১ দশমিক ৪৫ কোটি টন যার অর্থ ক্ষুধার আসন্ন হুমকি। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, যদি অপচয় না করা হয় তাহলে এই পরিমাণ খাদ্য দিয়ে তিন মাসের জন্য ১৭ কোটি মানুষের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।
খাদ্যের অপচয় এমন একপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যখন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির বিষয়ে সতর্ক করেছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও জনগণকে সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের বিষয়ে সতর্ক করেন এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি খালি জমি যাতে কৃষির আওতায় আসে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। কৃষিতে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি। প্রধান খাদ্যশস্য ধান ও গমের উৎপাদন গত অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯০ কোটি টন যা গত ১১ বছরের মধ্যে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। এই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ যা কিছু অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদিত হয় তার একটা ভালো অংশ ক্ষেত থেকে শুরু করে টেবিল পর্যন্ত একাধিকপর্যায়ে নষ্ট হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির খাদ্য অপচয়ের তথ্য অনুসারে, দেশে মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত যাত্রাপথে প্রতি বছর ৩৭ লাখ টনেরও বেশি খাবার নষ্ট হয়। বাড়িতে বার্ষিক খাদ্য বর্জ্য প্রায় ১.০৭ কোটি টন, কারন মোট বার্ষিক ক্ষতি এবং বর্জ্যরে পরিমাণ ১.৪৫ কোটি টন।
বাংলাদেশ প্রধানত একটি ধান উৎপাদনকারী দেশ এবং চাল প্রধান খাদ্য। দেশের মোট ফসলি জমির ৮০ শতাংশ ধান চাষের অধীনে এবং বছরে ৩ মৌসুমে ধান চাষ করা হয়। সুতরাং দেশের মানুষের জীবিকা নির্বাহে ধান একটি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মোট ক্যালরি সরবরাহের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এবং মোট প্রোটিন গ্রহণের প্রায় অর্ধেক আসে চাল থেকে।
বাংলাদেশে ধান সংগ্রহের পর সংরক্ষণের জন্য সাধারণত ডোল, বের, গোলা, মটকা, স্টিলের ড্রাম, প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্লাস্টিকের ড্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এ সমস্ত স্টোরেজ সিস্টেমে চাল বা ধানে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয় এবং বীজের ক্ষেত্রে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। দেশের এ সকল সনাতনী প্রথায় সংরক্ষণ করা ধান বা চালে পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে সবচেয়ে বেশি খাদ্যের অপচয় হচ্ছে। শুধুমাত্র আধুনিক স্টোরেজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারলেই অপচয়ের বিরাট অংশ রোধ করা সম্ভব।
বিশ্বে প্রতি ৯ জন মানুষের মধ্যে ১ জন অপুষ্টির শিকার অথচ প্রতি বছর ১ বিলিয়ন টনেরও বেশি উৎপাদিত খাদ্য সারাবিশ্বে নষ্ট হয়। জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের ২০২১ খাদ্য বর্জ্য সূচক রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর মাথাপিছু ৬৫ কেজি খাদ্য বর্জ্য তৈরি হয় যা অনেক উন্নত দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশী। খাদ্য বর্জ্যরে পরিমাণ প্রতি বছর মাথাপিছু যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ কেজি, রাশিয়ায় ৩৩ কেজি, আয়ারল্যান্ডে ৫৫ কেজি, নিউজিল্যান্ডে ৬১ কেজি এবং জাপানে ৬৪ কেজি। দেশের খাদ্য উৎপাদন ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করার চেয়ে অনেক কম প্রচেষ্টায় খাদ্যের অপচয় ৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। আর এর একটি সহজ উপায় হচ্ছে-হারমেটিক স্টোরেজ।
হারমেটিক স্টোরেজ যা “সিলড স্টোরেজ” বা “এয়ারটাইট স্টোরেজ” নামেও পরিচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যশস্য, ডাল, কফি এবং কোকো বিনের স্টোরেজ পদ্ধতি হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। পদ্ধতিটি সিল করা বায়ুরোধী ব্যাগ বা কাঠামো ব্যবহার করে উচ্চ কার্বন ডাই-অক্সাইড ঘনত্বের একটি স্বয়ংক্রিয় পরিবর্তিত বায়ুম-ল তৈরি করে। যেহেতু কাঠামোটি বায়ুরোধী সে কারণে শস্যের জৈব অংশ যেমন পোকামাকড়, বায়বীয় অনুজীব সময়ের সাথে সাথে শ্বসন বিপাকের কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইড ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। ফলে ভেতরের পোকামাকড় ও অনুজীব অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। এতে শস্যে আলফা টক্সিন উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পায়।
হারমেটিক স্টোরেজের জন্য বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত ব্যাগ বা কনটোইনার ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের মধ্যে সুপার গ্রেইন ব্যাগ, গ্রেইনপ্রো ব্যাগ, কোকুন (৫-৫০ টনের জন্য), বাংকারস, পিটস টানেল, সাইলো ব্যাগ, জিরোফ্লাই ব্যাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হারমেটিক স্টোরেজে এসব ব্যাগ ব্যবহার করে শস্যবীজের বিশেষ করে ধানের ক্ষেত্রে বীজের অঙ্কুরোদগমের হার ৯৮-৯৯ শতাংশ পাওয়া যায়, যা আমাদের দেশের সনাতনী পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পাওয়া সম্ভব। সুতরাং গুণগত মানসম্পন্ন সতেজ বীজ নিশ্চিত করতে হলে হারমেটিক ব্যাগের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে দেশের ক্ষুদ্র চাষিপর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার বাড়াতে হলে হারমেটিক স্টোরেজ পদ্ধতির ব্যবহার অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি ধানের সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্লেটে নেয়া পর্যন্ত সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধ করার জন্যও হারমেটিক স্টোরেজ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
হারমেটিক স্টোরেজে যে সকল পলিপ্রপিলিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয় এদের একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পোকামাকড় বা ইদুর এ সমস্ত ব্যাগ কাটতে বা ছিদ্র করতে সক্ষম যার ফলে ব্যাগের ভেতর ও বাইরের আবহাওয়াগত পরিবেশ একই রকম হয়ে যায় এবং এতে হারমেটিক স্টোরেজের সুফল পাওয়া যায় না। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আব্দুল আউয়াল এবং তার বিশেষজ্ঞ দল গবেষণা করে বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য উপযোগী ধাতব কনটোইনারে হারমেটিক স্টোরেজের গুণাবলি যুক্ত করেছেন যা পোকামাকড় বা ইঁদুর কাটতে বা ছিদ্র করতে পারবে না এবং এর ব্যবহার অনেক বছর পর্যন্ত করা সম্ভব হবে। ড. আউয়ালের মতে, এই ধরনের মেটালিক হারমেটিক স্টোরেজ দেশের ক্ষুদ্র কৃষকপর্যায়ে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ে কৃষকদের দিয়ে বীজ উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে এবং কৃষকপর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করছে। এক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত এই স্টোরেজ পদ্ধতিটি মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে কৃষকপর্যায়ে সুস্থ, সবল, নিরোগ বীজের ব্যবহার বাড়বে যা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত ধানের অপচয় কমানোর জন্য বিভিন্ন আকারের কোকুন ব্যবহার কৃষকপর্যায়ে বাড়াতে পারলে সংরক্ষিত ধানের অপচয় অনেক পরিমাণে কমে আসবে।
লেখক : কনসালট্যান্ট, গেইন বাংলাদেশ, মোবাইল : ০১৭১১৯৮৭১১৩, মেইল :monir.uddin@rookctonail.com